তখনও কলকাতা শহরের কোনও অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু প্রাচীন জনপদের বুকে দণ্ডায়মান ছিল এক কালীমন্দির। গোটা বাংলায় যে কালীমন্দির আজ কালীঘাট নামে বিখ্যাত। বলা হয়, এই কালীঘাটই কলকাতার অভিভাবক। মা কালী স্বয়ং রক্ষা করছেন কলকাতাকে। পীঠ নির্ণয় তন্ত্র মতে, কালীঘাট বাংলার অন্যতম সতীপীঠ। কথিত আছে, এখানেই পতিত হয়েছিল সতীর ডান পায়ের চারটে আঙুল।
আরও পড়ুন - বাংলার সতীপীঠের সবকটি কাহিনি এই লিঙ্কে
শিবের প্রলয় নৃত্য
তখন সত্যযুগ। প্রজাপতি দক্ষ আয়োজন করেছেন এক মহাযজ্ঞের। স্বর্গের সব দেবতা সেই যজ্ঞে আমন্ত্রণ পেলেও আমন্ত্রণ পাননি শিব। দেবাদিদেব মহাদেবের এই অপমানে ক্রুদ্ধ হয়ে সভায় উপস্থিত হন সতী। বিনা আমন্ত্রণে সতী সেখানে উপস্থিত হলে দক্ষ তাঁর সামনেই শিবের নিন্দা করেন। এই নিন্দা সহ্য করতে না পেরে যজ্ঞের আগুনে ঝাঁপ দেন সতী। সতীর আত্মবিসর্জন বিহ্বল করে দেয় শিবকে। তিনি সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে প্রলয়নৃত্য শুরু করেন। তখন বিশ্ব ধ্বংস হওয়ার জোগাড়। চারিপাশ থরহরি কম্পমান। এই সময় আবির্ভূত হন বিশ্বের পালনকর্তা বিষ্ণু। তিনি সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ খণ্ডবিখণ্ড করে দেন। সেই ৫১ খণ্ডের মধ্যে একটি খণ্ডই এসে পড়ে কালীঘাটে। কথিত আছে, খণ্ডগুলি পৃথিবীতে পড়ামাত্রই প্রস্তরীভূত হয়ে যায়। পরে সেখানে গড়ে ওঠে সতীপীঠ। কালীঘাটে পতিত হয়েছিল সতীর ডান পায়ের চার আঙুল।
আরও পড়ুন - পাতাল থেকে তুলে আনেন রাম-লক্ষণ! বর্ধমানের এই সতীপীঠে এক রীতি ভয়ানক
কীভাবে হল মন্দির প্রতিষ্ঠা?
কালীঘাটের মন্দির প্রতিষ্ঠা নিয়ে একাধিক কিংবদন্তী প্রচলিত রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় কিংবদন্তী হল সাধক আত্মারাম ব্রহ্মচারীর কাহিনি। কথিত আছে, বহুকাল আগে বর্তমান কালীঘাট অঞ্চলে তিনি মাতৃসাধনা করতে উপনীত হন। ধ্যানে বসেছিলেন এক বেদীর উপর। কিছুকাল ধ্যানের পর হঠাৎ একদিন দৈববাণী হয়। আত্মারাম শুনতে পান, তিনি যে বেদীর উপর বসে ছিলেন সেটি ব্রহ্মবেদী। স্বয়ং ব্রহ্মা ওই বেদীতে বসে তপস্যা করেন। তখনই তাঁর কাছে বিশেষ নির্দেশ আসে। নীলগিরি পর্বতে সাধক ব্রহ্মানন্দ গিরির কাছে থাকা শিলাস্তম্ভ এনে এই ব্রহ্মবেদীতে প্রতিষ্ঠিত করতে বলা হয়। দৈবকণ্ঠের আরও নির্দেশ, কালীয় কুণ্ডের মধ্যে নিমজ্জিত সতীর পায়ের আঙুলকে তুলে এনে পুজো করতে হবে।
আরও পড়ুন - পুজো হয় ৫১ কুমারীর! তীব্র গরমেও শুকোয় না কুণ্ডের জল? এই সতীপীঠের কাহিনী জানেন?
শিলাস্তম্ভ থেকে মাতৃমূর্তি
আত্মারাম দৈববাণা পাওয়ামাত্রই কালবিলম্ব না করে বেরিয়ে পড়েন নীলগিরির উদ্দেশ্যে। সেখানে পৌঁছে ব্রহ্মানন্দ গিরির কাছে ওই শিলা দেখতে পান। কথিত আছে, ১২ হাত লম্বা ও ২ হাত চওড়া ওই শিলা নিয়ে আসার চেষ্টা করতেই দৈববল প্রযুক্ত হয়। অদৃশ্য দৈববলে আত্মারাম আদিগঙ্গার তীরে এসে পৌঁছান। এর পর স্বয়ং বিশ্বকর্মা সেখানে উপস্থিত হন। তিনিই ব্রহ্মবেদীতে প্রতিষ্ঠা করেন শিলাস্তম্ভটি। এর শিলাস্তম্ভটি মাতৃরূপ পায় বিশ্বকর্মার হাতেই।
আজও পুজো পায় চার আঙুল
কালীয় কুণ্ড থেকে যেদিন সতীর পায়ের চার আঙুল তুলে আনা হয়, সেদিন ছিল স্নানযাত্রা। ওই চার আঙুলকে মা কালীর বেদীর নিচে স্থাপন করা হয় ও পুজো করা হয়। সতীর ডান পায়ের চার আঙুলের সেই বিশ্বাস আজও প্রচলিত রয়েছে। তাই প্রতি বছর ওই দিন সকাল থেকে মন্দির বন্ধ থাকে। বয়ঃজেষ্ঠ্য সেবাইত চোখে কাপড় বেঁধে কুণ্ডের নিচ থেকে প্রস্তরীভূত ওই চার আঙুল বার করে আনেন। তাঁকে যথাযথ নিয়ম মেনে স্নান করান।